গ্রন্থ পরিচিতঃ ইমাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর বিখ্যাত বই এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বা ধর্মীয় জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন পড়া শেষ করলাম। নিজের মনে রাখার উদ্দেশে যে নোটগুলো করেছি, তার কিছু অংশ বন্ধুদের সাথে শেয়ার করছি। হয়তো কারো কারো এ বিষয়ে আগ্রহ থাকতে পারে। এই বইটি যেমন ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর জীবনের মোড় ঘুরে যাবার পর লেখা, তেমনি বইটি ইসলামি ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরণের পরিবর্তনও সূচিত করেছিল।
প্রথম অধ্যায়ের শুরুতে জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান চর্চা, জ্ঞানীর মর্যাদা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনাগুলো হয়েছে মূলতঃ কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় চোখে লাগার মত। তা হচ্ছে, কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতির সুনির্দিষ্ট উৎস উল্লেখ নেই। এমনকি কিছু কিছু দুর্বল বা জাল হাদীসও এখানে স্থান পেয়েছে। যেমন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও।’
আরেকটা হাদীসের কথা বলা হয়েছে, ‘আমার উম্মতের মধ্যে দুই শ্রেণীর লোক রয়েছে, যারা ঠিক হয়ে গেলে তাদের অনুসারী সকল মানুষ ঠিক হয়ে যায় এবং তারা বিগড়ে গেলে সকল মানুষ বিগড়ে যায়। তাদের এক শ্রেণী হচ্ছে শাসক এবং অপর শ্রেণী হচ্ছে ফেকাহবিধ অর্থাৎ দ্বীনি এলমে সমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ।’ অল্প কিছুটা খোঁজাখুঁজি করেও আমি এর উৎস পাইনি। কেউ জানলে অনুগ্রহ করে জানাবেন। তবে কথাটি যে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যদিও রেফারেন্স দেয়া থাকলে ভালো হতো, কিন্তু সেই সময় হয়তো বিস্তারিত রেফারেন্স দেয়ার রীতি ছিল বা বা খুবই কষ্টকর ছিল।
জ্ঞান অর্জন ও চর্চার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যা বলা হয়েছে মোটা দাগে তার সাথে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তবে রাসুল (সঃ) এবং সাহাবাগণের সময়কার ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বা বিশ্বসভ্যতার অন্যান্য অংশের উত্থান পতনের দিকে দৃষ্টি দিলে এ কথা মনে হতে পারে যে, জ্ঞান চর্চাকে কিছুটা বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতির জন্য জীবন দান থেকেও। উল্লেখ্য, অন্যান্য সকল সভ্যতার মতই ইসলামেও জাতির জন্য জীবন দেয়াকে সবচেয়ে বেশী মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
জ্ঞান অর্জন, অন্বেষণ ও বিতরণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বোঝানোর পর ইমাম গাজ্জালী (রঃ) জ্ঞানের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ করেছেন। কোন জ্ঞান অর্জন প্রত্যেকের জন্য ফরজ (ফরজে আইন) – এই আলোচনা করে তিনি বলেছেন, কোন ব্যক্তির উপর যে সব ইবাদত ফরজ, সেই বিষয়ক জ্ঞান অর্জনও তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ফরজ। যেমন কারো উপর যদি যাকাত ফরজ হয়, তবে যাকাত বিষয়ক জ্ঞান তার জন্য ফরজ। আবার ফেকাহ (আইন শাস্ত্র), চিকিৎসা বিদ্যা, বিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা, শিল্পবিদ্যা – ইত্যাদি জ্ঞানকে তিনি ফরজে কিফায়া বলেছেন, যা একটি সমাজের কিছু মানুষকে অবশ্যই অর্জন করতে হবে।
জ্ঞানের আরেক ভাগে তিনি রেখেছেন, ভালো তবে আবশ্যকীয় নয় – এমন জ্ঞানকে। যেমন কবিতা, ইতিহাস ইত্যাদি।
তবে এই সকল জ্ঞানকেই তিনি দুনিয়া মুখী জ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে যাকাত সম্পর্কিত জ্ঞান একটি দুনিয়াবী জ্ঞান, কেননা, এই জ্ঞানের মাধ্যমে (সেই সময়ে) রাষ্ট্র অর্থ সংগ্রহ করতো। মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কিত জ্ঞানও তার বিচারে দুনিয়ামুখী জ্ঞান, আখেরাতমুখী নয়। তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, একজন আলেম বছরের একটা সময়ে তার সকল সম্পদ স্ত্রীকে হস্তান্তর করতেন যাকাত না দিতে হয়, সে জন্য। এর ফলে রাষ্ট্রের আইনে তার যাকাত মাফ হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তার নিয়তের জন্য আখেরাতে সুফল পাবেন না।
এখানে এসেই তিনি বাতেনী জ্ঞান, রূহানী জ্ঞান – ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
‘আখেরাত বিষয়ক জ্ঞান’ অধ্যায়ে তিনি আখেরাত সম্পর্কিত জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন – এলমে মুকাশাফা বা বাতেনী জ্ঞান এবং এলমে মুয়ামালা বা বিশুদ্ধভাবে জীবন যাপনের জ্ঞান। এলমে মুকাশাফা বা বাতেনী জ্ঞানকে আমি যতদূর বুঝেছি, তা হল, এই জ্ঞান হচ্ছে স্রষ্টা সম্পর্কে মানুষের নিজস্ব উপলব্ধি, যা কোথাও বিস্তারিত লেখা থাকে না, বরং যা মানুষ স্রষ্টা সম্পর্কে চিন্তা করতে করতে উপলব্ধি করে। তবে এই বিষয়ে ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) খুব স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। আমার মতে এই জ্ঞান বা উপলব্ধি স্রষ্টাকে নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করতে করতে মানুষের কাছে পরিস্কার হতে থাকে, সে যেন ধোয়াশা থেকে আলোর দিকে যেতে থাকে। একেই হয়তো সুফীগণ নূর বা আলো বলে থাকেন। বিষয়টি এমন যে আপনি দিনের অধিকাংশ সময় আল্লাহ, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ক্ষমতা – এ সব নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন, যা কিছু আপনার চোখের সামনে পড়বে, তাতেই আল্লাহর ছোঁয়া দেখতে পাবেন। দেখা যাবে, আপনার জাগ্রত সময়ের অধিকাংশ কেটে যাবে, আল্লাহর স্মরণে। আল্লাহকে উপলব্ধি করার এবং নৈকট্য লাভ করার অভিজ্ঞতা তখন আপনার হবে।
তবে, ইমাম গাজ্জালী যা বলেননি, তা হচ্ছে, এই জ্ঞানের একটি বিপদজনক দিকও রয়েছে। মানুষ তার নিজের মত করে স্রষ্টাকে কল্পনা করে নেয়। এই কল্পনা যদি কুরআন-হাদীস দ্বারা চালিত না হয়, তাহলে তা ভুল পথে চলে যেতে পারে। চিনুয়া আচেবের ‘থিংস ফল এপার্ট’ উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক কিশোরটি তার মত করে ঈশ্বরকে কল্পনা করে নেয় এবং তার কাছে নিজের চাওয়া-পাওয়া, দু:খ-কষ্ট সব বলতে থাকে।
এলমে মোয়ামালা হচ্ছে অন্তরের ভালো মন্দ অবস্থা জানা এবং কীভাবে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে হবে – সে বিষয়ক জ্ঞান। এই পরিশুদ্ধির ভিত্তি হচ্ছে, দুনিয়ামুখীতা পরিহার করে পরকালমুখী হওয়া। দুনিয়া বিমুখ হওয়া আর সংসার ত্যাগী হওয়া কিন্তু এক কথা নয়। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এই অধ্যায়ে লিখেছেন, মানুষের অর্থ সম্পদ না থাকা সংসার বিমুখতা নয়, সংসার বিমুখতা হচ্ছে অর্থ সম্পদের প্রতি বেপরোয়া ভাব। অর্থাৎ, আপনি দুনিয়াতে বাস করেও দুনিয়ার প্রতি আপনার মোহ থাকবে না। বিষয়টা কেমন? ধরুন, আপনি চাকুরী করেন। জীবন চালাতে অর্থ প্রয়োজন। সে জন্য আপনি চাকুরী করেন, আপনার কাজ সাধ্যমত ভালোভাবে করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চাকুরী আপনার জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। আপনি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে মাথা ঘামান, অন্য কারো সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে নয়। চাকুরী জীবনের বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি – এসব বিষয়ে আপনি বেপরোয়া, এগুলো আপনাকে প্রভাবিত করে না।
এই বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে ইমাম গাজ্জালী চার মাজহাবের মহান ইমামগণের উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁরা সকলেই শাসকদের দেয়া পদ-পদবী, উপহার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতেন, তাঁরা যাতে কোনভাবেই প্রভাবিত না করেন – সে বিষয়ে যত্নবান থাকতেন। এর ফলে তাঁদের প্রত্যেককেই বার বার জেলে যেতে হয়েছে, কঠোর শারিরীক শাস্তি পেতে হয়েছে। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বইতে এই রকম দৃঢ়চেতা অকুতভয় সুফীবাদের কথাই লিখেছেন।
জ্ঞান বিষয়ক শব্দের ব্যবহার যেভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে – এই অধ্যায়ে ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে ফেকাহ, এলেম, তাওহীদ, তাযকীর, হেকমত – এই পাঁচটি শব্দের ব্যবহার পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে ভুল অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন তাঁর মতে রাসুল (সঃ), সাহাবা ও তাবেইনদের সময়ে ফেকাহ শব্দ দ্বারা বোঝানো হতো আখেরাতে পথ, প্রবৃত্তির অনিষ্ট থেকে বাঁচা – এই সকল বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও উপলব্ধিকে। কালক্রমে যা পরিণত হয়ে ইসলামি আইনের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণে। অথাৎ, একটি আখেরাতমুখী বিষয়কে দুনিয়ামুখী ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছে।
এলেম শব্দটির ব্যবহারে পরিবর্তন নিয়ে তিনি বলেছেন, আগে আলেমওলা হতো তাঁদের যারা আল্লাহতায়ালা, তাঁর বিধিবিধান, ক্রিয়াকর্ম ও গুণাবলী – এসব বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখতেন। কিন্তু তাঁর সময়ে আলেম হিসেবে তারাই পরিচিত হন, যারা বিরোধপূর্ণ মাসলা-মাসায়েল নিয়ে তর্কে পারদর্শীতা লাভ করে থাকেন।
যিকির ও তাযকীর শব্দের ব্যবহারের পরিবর্তন নিয়ে তিনি বলেছেন, আগে জিকির ব্যবহৃত হতো, আল্লাহর স্মরণে কুরআন ও হাদীস আলোচনাকে, পরবর্তীতে যিকিরের নামে বানানো কেচ্ছা কাহিনী চালু হয়ে গেছে।
এই অধ্যায়ে তিনি সুফীদের বাড়াবাড়ির বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, মারেফতি বা বাতেনী অর্থ খুজতে গিয়ে যেন কুরআনের আয়াতের বাহ্যিক অর্থের বাইরে অন্য কোন অর্থ না করা হয়।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) নামাজের ৬টি বাতেনী বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যার মাধ্যমে নামাজ পূর্ণতা পায়। সেগুলো হচ্ছেঃ
ক. অন্তরের উপস্থিতি – অর্থাৎ পরিপূর্ণ একাগ্রতার সাথে ননামাজ পড়া
খ. নামাজে পঠিত বিভিন্ন আয়াত ও দোয়ার অর্থ বোঝা ও হৃদয়াঙ্গম করা। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর মতে, পরিপূর্ণ একাগ্রতার থাকলে আয়াত ও দোয়ার এমন সব গভীর অর্থ হৃদয়াঙ্গম করা সম্ভব যা অন্য সময়ে সম্ভব নয়।
গ. ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন – নামাজে আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
ঘ. শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় – গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকে যে ভয় তৈরী হয়, নামাজের মধ্যে তা থাকতে হবে।
ঙ. আশা – নামাজের মধ্যে সর্বদা আল্লার রহমত, মাগফেরাত ও বরকতের আশা করতে হবে।
চ. নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জা ও অনুতাপ
কোরআন পাঠকে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বইটিতে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বেশ কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করে বুঝিয়েছেন, যে বাড়ীতে কুরআন পাঠ হয় না, সে বাড়ী থেকে ফেরেশতা চলে যায় এবং সেখানে শয়তান প্রবেশ করে। অপরদিকে যে বাড়ীতে নিয়মিত কোরআন পাঠ হয়, সে বাড়ীতে ফেরেশতা প্রবেশ করে ও শয়তান পালিয়ে যায়।
আবার যাবার কোরআন পাঠ করে, কিন্তু এর নির্দেশসমুহ বাস্তবায়নের বিষয়ে চেষ্টা করে না, তাদের বিষয়ে তিনি হযরত উবনে ওমর ও জন্দুব (রাঃ) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রাসুলে করীম (সঃ) এর সময় আগে মানুষ ঈমান আনতেন, তারপর কোরআন জানতেন। যখনই কোরআনের কোন আয়াত নাযিল হতো, তারা সাথে সাথে সেই আয়াতের নির্দেশগুলো পালনে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অর্থাৎ কোরআনের প্রাথমিক উপলক্ষ্য ছিল নির্দেশ পালনের বিষয়ে। পরবর্তীতে অনেকেই কোরআন পুরোটা জানে, কিন্তু নির্দেশ পালনের বিষয়ে আগ্রহী হয় না।
এরপর তিনি তাওরাতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ বলেন, তোমাদের চলার পথে কারো চিঠি যদি তোমাদের কাছে পৌছাঁয়, তাহলে তোমরা চলা থামিয়ে দিয়ে এক পাশে গিয়ে তখনই চিঠিটা পড়ে নাও। অথচ, আল্লার বার্তা তোমাদের কাছে প্রেরণের পরও তাতে কী আছে, তা জানার আগ্রহ তোমাদের হয় না।
এর পর তিনি কোরআন তেলাওয়াতে জাহেরী (দৃশ্যমান) ও বাতেনী (অভ্যন্তরীণ) শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বাতেনী (অন্তনির্হিত) শিষ্টাচারের মধ্যে রয়েছেঃ
১. খোদায়ী কালামের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব হৃদয়াঙ্গম করতে হবে।
২. কোরআন পাঠ শুরুর আগে আল্লাহর কালামের মাহাত্মের ধারণায় মন পরিপূর্ণ রাখা।
৩. তেলাওয়াতের সময় অবচতেন মনে হলেও অন্য কোন চিন্তা না রাখা।
৪. পঠিত বি��য় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা।
৫. কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে কয়েক বিষয় বাধার তৈরী করে, সেগুলো হচ্ছেঃ
ক. কুরআনের অর্থ বোঝার দিকে মনোযোগ না দিয়ে শুদ্ধভাবে উচ্চারণের দিকে অধিক মনোযোগ দেয়া।
খ. কোন একটি মতবাদের অনুসারী হয়ে যাওয়া – তখন কুরআনের বক্তব্য তার অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না।
গ. কোন গোনাহে অব্যাহতভাবে লিপ্ত থাকা
ঘ. কোন একটি তাফসীর সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে এটিই একমাত্র শুদ্ধ তাফসীর
৬. কুরআনের প্রতিটি সম্বোধনকে নিজের প্রতি সম্বোধন হিসেবে মনে করা
৭. তেলাওয়াতের সময় যখন যে ধরণের বিষয়বস্তা আসবে, সে ধরণের প্রভাব হৃদয়ে তৈরী করা
বিয়ে প্রসঙ্গে পুরো দুটি অধ্যায় রয়েছে এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বইটিতে এবং দীর্ঘ প্রায় ৭০ পৃষ্ঠা ধরে তিনি বিয়ের বিভিন্ন আঙ্গিক বর্ণনা করেছেন। প্রথমে তিনি আলোচনা করেছেন, বিয়ের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বা আদৌ আছে কিনা, উপকারিতা-অপকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে আলোকপাত করেছেন। তারপর কুরআন-হাদীস এবং ইসলামি পন্ডিতদের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেনে যে বিয়ে খুবই জরুরী একটি বিষয়। তিনি এও বলেছেন, যদি কারো একদিন মাত্র জীবন থাকে, সেই একদিনের জন্যও তার বিয়ে করা উচিৎ। হাদীসের উদ্ধৃতি ছাড়াও তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বিয়ে ছাড়া ইবাদত পূর্ণতা পায় না। বিয়ে না করলে শারিরীক চাহিদা অবদমিত থাকার কারণে মানুষের মনের স্থিরতা আসে না, ফলে সে ইবাদতে মন বসাতে পারে না। তাছাড়া বিয়ের ফলে অন্যের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেয়া, শিশুদের লালন-পালন করা, বংশ বৃদ্ধি করা – এগুলোও সওয়াব অর্জনে সহায়তা করে।
বিয়ের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে কনের গ্রহণীয় ও বর্জনীয় দোষ-গুণ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। কনের তিনটি গুণের দিকে তিনি জোর দিতে বলেছেন:
১. সৎ চরিত্র এবং ধর্মপরায়নতা
২. সদাচার
৩. রূপ লাবণ্য
৪. মোহরানা কম হওয়া
৫. বন্ধ্যা না হওয়া
৬. কুমারীত্ব
৭. বংশের আভিজাত্য
৮. নিকটাত্মীয় না হওয়া
স্বামীদের আদব সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এক যায়গায় হযরত ওমর (রাঃ) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘পুরুষদের উচিৎ, নিজের ঘরে শিশুদের মত হয়ে থাকা।’ এবং ‘স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলেও নিজের মতানুসারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ না হওয়া, এমনকি হঠাৎ বাড়ীতে উপস্থিত না হওয়া, তার গোপণ বিষয় কোনভাবেই প্রকাশ না করা – ইত্যাদি পরামর্শও তিনি দিয়েছেন।
এই অধ্যায়ে তিনি স্বামী-স্ত্রীর মিলনের শিষ্টাচারও বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া জন্মশাসনকে বৈধ বলেছেন এবং পুত্র সন্তান হলে কন্যা সন্তান হওয়ার চেয়ে বেশী খুশী হওয়াকে নিষেধ করেছেন।
জীবিকা উপার্জনের জন্য নিজে কাজ করাকে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) উৎসাহিত করেছেন। কাজ না করে অন্যের অর্থে জীবনযাপন করাকে তিরস্কার করেছেন। তবে তিনি চার শ্রেণীর মানুষের জন্য অনুদানের অর্থে জীবন ধারণকে বৈধ বলেছেন – যারা মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করেন, জ্ঞান বিতরণ করেন, মানুষকে হেয়াদাত দান করেন এবং শাসন কার্য পরিচালনা করেন, তাদের নিজেদের জন্য আলাদা ভাবে উপার্জন না করলেও হবে। অর্থাৎ, তারা অনুদানে জীবন চালাতে পারবেন।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) শাসকদের কাছ থেকে আলেমদেরকে দূরে থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, শাসক যদি অত্যাচারি হয়, তাহলে তাকে পদচ্যুত করা ওয়াজিব। তা না করে, তার কাছে যাওয়া অতীব নিন্দনীয়। অবশ্য অত্যাচারি শাসক যদি আলেমের কাছে আসেন, তাহলে তাকে সম্মান করতে হবে এবং তার সামনে সত্য কথা বলতে হবে। কোন ভাবেই তার অত্যাচারের সমর্থন হয়, এমন কিছু করা যাবে না। তবে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই উত্তম বলে তিনি মত দিয়েছেন।
দোয়া ও জিকির সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেছেন যে, যতদূর সম্ভব দোয়া ও আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকা উচিৎ। দোয়া ও জিকির অভ্যাসের বিষয়। অভ্যাস করতে থাকলে এক সময় মানুষ এর মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যেতে পারে। তিনি জিকিরের সাথে ধর্ম যুদ্ধে শাহাদাতের সম্পর্ক দেখিয়ে বলেছেন, শাহাদাত বরণ হচ্ছে জিকিরের সর্বোচ্চ পর্যায়। কেননা, সেই পর্যায়ে গিয়ে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বইটিকে সুফিবাদের রূপরেখা সম্পর্কিত সবচেয়ে শক্তিশালী বই হিসেবে ধরা হয়। এই বইটির কারণেই সুফিবাদ ব্যাপক প্রসার লাভ করে এবং ইসলামের একটি মত-পথ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বিশাল এই বইটিতে লেখক ইসলামী বিশ্বাস ও ইবাদতগুলোর পরিচয় দিয়েছেন দুই আঙ্গিকে – জাহেরী বা বাইরের রূপে এবং বাতেনী বা অন্তর্নিহিত রূপে। বিষয়টি জটিল মনে হলেও আসলে সহজ। বাইরের রূপটি হচ্ছে, যা অন্য মানুষ দেখে এবং যা আইন, সামাজিকতা ইত্যাদি বিবেচনা করে। যেমন একজন মানুষ জামায়াতে নামাজ পড়লে আইন ও সমাজ তাকে নামাজী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু, নামাজের সময় তিনি হয়তো মনোযোগী থাকেন না। বাতেনী অংশে ইমাম গাজ্জালী বর্ণনা করেছেন, কীভাবে নামাজে মনোযোগী হতে হবে। এই কাজটি তিনি সকল ইবাদতের জন্য করেছেন এবং অত্যন্ত গোছালোভাবে সম্পন্ন করেছেন। এটিই সুফিবাদ। মনকে পরকালমুখী করা, সকল ইবাদত ও কর্মকান্ডকে দুনিয়ার বদলে আখেরাতের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করা। এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি কুরআন ও হাদীস থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির কথাও উল্লেখ করেছেন।
আমার মনে হয়েছে, এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বইটি যে ব্যাপক প্রচার-প্রসার পেয়েছে এবং সুফিবাদকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে, তার মূলে ছিল ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর উপস্থাপনা। সেই সময়ে ইসলামি চিন্তা তিনটি প্রধান মত অনুসরণ করতো। বাতেনী পথের অনুসারীরা ইসলামের ইবাদত ও আচারের অন্তনির্হিত রূপটির দিকে জোর দিতেন। ফেকাহবিদগণ ইসলামি আইন ও মাসআলা-মাসায়েলের চর্চা করতেন আর দার্শনিকগণ যুক্তি দিয়ে সব কিছুর ব্যাখা করার চেষ্টা করতেন। বইটিতে ইমাম গাজ্জালী এই তিন পথের একটি সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। বাতেনী ধারা ইসলামের মনগড়া ব্যাখা দিতো। তার থেকে সরে এসে তিনি কুরআন-হাদীস থেকে ইবাদতসমূহের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরলেন।
ফিকাহকে তিনি বললেন, যে এটি আবশ্যকীয় তবে এটিই সব নয়। যেমন নামাজ জামায়াতে পড়তে হবে। তবে তাতেই সব হয়ে গেল না। নামাজের ফল পেতে হলে অবশ্যই পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে এবং আদব (শিষ্টাচার) মানতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন ইবাদতের পূর্ণ রূপ মানুষ দেখতে পেল, তেমনি বাতেনী জ্ঞানের নামে কুরআন-হাদীস থেকে দূরে সরে যাওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়লো। বইটিতে সুফিবাদের যে পরিচ্ছন্ন রূপটির সাথে আপনার পরিচয় হবে, তার সাথে আমাদের বর্তমান ধর্ম সম্পর্কে ধারণার খুব বেশী পার্থক্য নেই এবং বর্তমানের সুফিবাদ হিসেবে পরিচিত মতবাদেরও তেমন একটা সম্পর্ক নেই।
ইমাম গাজ্জালী রহঃ কর্তৃক রচিত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে নামের উপর ক্লিক করুন।
এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ১ম খণ্ড
এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ২য় খণ্ড
এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৩য় খণ্ড
এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৪র্থ খণ্ড
এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৫ম খণ্ড
আবার ভিজিট করবেন!!! ধন্যবাদ