মৃত্যু নিশ্চিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়ে উদাসীন। একজন মুসলিমের করণীয় হলো, মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা এবং তার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা। অনুরূপভাবে দুনিয়াতে থাকতে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পরপারের পাথেয় সঞ্চয় করা।
মানুষ মরণশীল। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে স্থায়ী নয় কেউ-ই। দুনিয়ার টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ছেড়ে একদিন পাড়ি জমাতে হবে ওপারে। যেখানে বন্ধু হবে না কেউ, হবে না শত্রুও।
নিজেকেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।
পবিত্র কোরআন শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোটি কোটি মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে ভেতর থেকে, খুলে দিয়েছে তাদের সম্ভাবনার দ্বার, দিয়েছে প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত জীবন। এই জীবনের সঙ্গে মৃত্যুও যে জড়িত তাও উল্লেখ আছে আল-কোরআনে। শুধু কোরআনে নয়, হাদিসেও আছে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক আলোচনা।
মৃত্যু সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কী বলে?
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমরা নিজ নিজ কাজের প্রতিফল সম্পূর্ণভাবেই কিয়ামতের দিন পাবে…।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫; সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৫৭)
‘অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা ত্বরান্বিত করতে পারবে না।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৬১)
‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫৬)
‘হে মুমিনরা, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল না করে। যারা এ কারণে গাফিল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।
আমি তোমাদের যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় করো। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরো কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’ (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত : ৯-১১)
‘মুমিনদের জন্য কি এখনো সে সময় আসেনি যে তাদের হূদয় আল্লাহর স্মরণে বিগলিত হবে? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদের আগে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। তাদের ওপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের বেশির ভাগ পাপাচারী।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ১৬)
‘আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত : ৪০-৪২)
মৃত্যু সম্পর্কে হাদিস কী বলে?
ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাঁধ ধরে বললেন, ‘দুনিয়াতে এভাবে কাটাও যেন তুমি একজন মুসাফির বা পথিক।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬; তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩৩; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১১৪)
ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে সকাল বেলার অপেক্ষা (আশা) করো না এবং সকালে উপনীত হয়ে সন্ধ্যা বেলার অপেক্ষা করো না। সুস্বাস্থ্যের দিনগুলোতে রোগব্যাধির (দিনগুলোর) জন্য প্রস্তুতি নাও এবং জীবদ্দশায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬; তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩৩; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১১৪)
ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) একটি বর্গক্ষেত্র আঁকলেন, তার মাঝ বরাবর কয়েকটি সরল রেখা টানলেন, যা বর্গক্ষেত্র ভেদ করে বাইরে চলে গেছে। তিনি মধ্যবর্তী এ রেখাটির সঙ্গে যুক্ত আরো কতগুলো ছোট ছোট সরল রেখা (আড়াআড়িভাবে) টানলেন, তারপর বলেন, ‘এটা হলো মানুষ এবং এটা তার মৃত্যু, যা তাকে বেষ্টন করে আছে। (বর্গক্ষেত্র ভেদ করে) বাইরে বেরিয়ে যাওয়া রেখাটুকু হচ্ছে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা। ছোট রেখাগুলো হলো তার জীবনের বিপদ-আপদ। একটি বিপদ থেকে ছুটতে পারলে অপর বিপদ এসে তাকে বিচলিত করে। আবার দ্বিতীয়টি থেকে রেহাই পেলে তৃতীয়টি তাকে নিষ্পেষিত করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১৭; তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৪; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৩১)
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সাতটি জিনিস প্রকাশ পাওয়ার আগেই তোমরা নেক কাজের দিকে সত্বর অগ্রসর হও :
তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা অমনোযোগী (অক্ষম) করে দেয়;
অথবা এমন প্রাচুর্যের, যা ধর্মদ্রোহী বানায়;
অথবা এরূপ রোগ-ব্যাধির যা (দৈহিক সামর্থ্যকে) তছনছ করে দেয়;
অথবা এমন বৃদ্ধাবস্থার, যা জ্ঞান-বুদ্ধিকে লোপ করে দেয়;
অথবা এমন মৃত্যুর, যা অলক্ষ্যেই উপস্থিত হয়;
কিংবা দাজ্জালের, যা অপেক্ষমাণ নিকৃষ্ট অনুপস্থিত বস্তু;
অথবা কিয়ামতের, যা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও তিক্ত।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩০৬)
আবু হুরায়রা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (দুনিয়ার) স্বাদ-আহলাদ নিঃশেষকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩০৬)
ইবন উমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। এ সময় একজন আনসার তার কাছে আসে। সে নবীকে (সা.) সালাম করে বলে, হে আল্লাহর রাসুল, সর্বাপেক্ষা উত্তম ঈমানদার কে? তিনি বলেছেন, তাদের মধ্যে যাদের চরিত্র উত্তম। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করে, সর্বাপেক্ষা পারদর্শী ঈমানদার কে? তিনি বলেন, যারা মৃত্যুকে বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, এরাই সর্বোত্তম দূরদর্শী।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫৯)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা, সে পুণ্যবান হলে সম্ভবত সে পুণ্য বৃদ্ধি করবে। আর পাপী হলে (পাপ থেকে) তাওবা করতে পারবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৯, ৫৬৭৩)
প্রত্যেকেরই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। এটা এক সেকেন্ডও এদিক-সেদিক হবে না। কখন মৃত্যু আসবে, মানুষ জানে না। মানুষ যেন মৃত্যুকে ভুলেই থাকে। দুনিয়ার আরাম-আয়েশের পেছনে ছুটে চলা দেখলে তো তাই মনে হয়। দুনিয়ায় মানুষের যত কর্ম, সবই সেদিন প্রকাশিত হবে। কোনো কিছু সেদিন আর গোপন থাকবে না। আমরা কেন ভুলে যাই- দৃশ্য-অদৃশ্য যা কিছু হয়; সবই আল্লাহপাক দেখেন। মানুষের মনের কথাও আল্লাহপাক জানেন। মানুষ মানুষকে ফাঁকি দিতে পারে; কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। এই চিন্তাটুকু মাথায় থাকা জরুরি। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি বলুন, ‘তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে চাও, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের কাছে পৌঁছবে। অতঃপর তোমরা অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। আর তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন তোমাদের সেসব কর্ম, যা তোমরা দুনিয়াতে করতে।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত : ৮)
অতএব, প্রত্যেক মানুষ তার অন্তরে ভালো কাজের তাড়না অনুভব করে—সেই সঙ্গে অনুভব করে তার কুপ্রবৃত্তির তাড়নাও। কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখলেই আছে সুসংবাদ।
আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ