বই পর্যালোচনাঃ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবপ্রেম, প্রেম, ভালোবাসা, অশ্রু, যুদ্ধজয়, রণাঙ্গনের বীরত্বকথা, মমতাময়ী মায়ের আদর, পিতার স্নেহ, বন্ধুত্বের বন্ধন, প্রজার প্রতি রাজার আত্মত্যাগ, হিন্দু অচ্ছুৎ জাতির সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষনীয় ইতিহাসের এক মলাটবদ্ধ উপহার। ড. করম হোসাইন শাহরাহি তাঁর লেখিত পাঁচ খণ্ডের বিশাল ‘রাজকুমারী’ উপন্যাসে নির্লজ্জ, বেহায়া, লোভী, ধর্মান্ধ, স্বার্থান্বেষী লোকদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। তিনি কল্পিত কাহিনির পথ ছেড়ে কঠিন বাস্তবতাকে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে। তাঁর উদ্দেশ্যই ছিলো ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করে চেপে রাখা ইতিহাসের খবর দেওয়া। তিনি কোনো পেশাধারী লেখক নন। সময়ের খুব বেশি প্রয়োজনে জাতির উপকারার্থে তিনি যে কলম ধরেছেন তা সহজেই বোঝা যায়। তাই তো তাঁর লেখিত আর কোনো উপন্যাস-গ্রন্থ বা বইয়ের খোঁজ মেলেনি। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রহস্যঘন অতীত তার ঘুর্ণিবাতাসের বিচিত্রিত কান্না-হাসির প্রাঞ্জল বর্ণনা ‘রাজকুমারী’ সিরিজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ শতকে বাংলা ভূখণ্ডের নজিরবিহীন সফল শাসক আলি কুলি খানের কীর্তি কাহিনি প্রস্ফুটিত হয়েছে ড. করম হোসাইন শাহরাহির কলমের প্রতিটি খোঁচায়। উর্দু ও সাংস্কৃতিক শব্দের মিশেলে তার এই একটিমাত্র উপন্যাস। অগোচরে থাকা ইতিহাসের সঠিক জ্ঞানের উপঢৌকন, মুসলিম বীরদের গৌরবান্বিত ঘটনাবলি, বাংলাভাষীদের হাতে তুলে দেওয়ার কঠিন স্বপ্ন দেখলো নবপ্রকাশ-পরিবার। উপন্যাসটি বাংলাভাষায় অনুবাদের জন্য তারা তুলে দিলেন রুচিশীল লেখক, অনুবাদক ও বিশ্লেষণধর্মী সফল কলাম-লেখক কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক সাহেবের হাতে। তাঁর দক্ষতার ফলে আপনি পাবেন রাজকুমারীর প্রতিটি লাইনে সাহিত্যরসের অনন্য স্বাদ। তিনি ফাসাহাত বলাগাতের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করেছেন প্রতিটি শব্দ।
এ এক অনবদ্য ইতিহাসের চিত্তাকর্ষক উপাখ্যান। এক চেপে রাখা ইতিহাসের মোড়ক উন্মোচন। উপন্যাসটি শুরু একজন নারীর করুন দুঃখগাঁথা কাহিনী দিয়ে। বিমলা দেবী। ভদ্রেক নামক ছোট্ট এক গ্রামের রাম দাসের কন্যা। রূপে গুনে অনন্যা বিমলা জগন্নাথ মন্দিরে আরতি ও অর্চনার মেলায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে গমন করে বান্ধবী কামিনীর সাথে। আসাম, ভুটান, নেপাল, বাংলা ও হিন্দুস্থানের দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী নিজ নিজ কুমারী কন্যাদের নিয়ে সমবেত হয় এই জগন্নাথ মন্দিরে। উদ্দেশ্য জগন্নাথ দেবতার পূজা অর্চনা করা। নিয়ম মত শত শত সুন্দরী কন্যাদের মধ্য থেকে বিমলাকে সেরা সুন্দরী কন্যা হিসেবে বাছাই করা হয় এবং দেবতা ভগবানের দেবী হিসেবে মুল্যবান মুকুট পরানো হয়। বিমলা জানতো সে শুধুই দেবতার দেবী হিসেবে আগামী একবছরের জন্য জগন্নাথ দেবী রূপে নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বিমলা অনুভব করে তার ওপর শারীরিক অত্যাচার হচ্ছে এবং মন্দিরের মহাত্মা ও মহাদেব উভয়ই জগন্নাথ দেবতার অবতার হিসেবে নিজেদের দাবি করে রাতভর পাশবিক অত্যাচার চালায়।বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুরম্য অতীত আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ লড়াইয়ের দাস্তান প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত হয়েছে এ গ্রন্থে। এ গ্রন্থ কেবল একটি উপন্যাস নয়, এ গ্রন্থ এমন এক ইতিহাসের জানান দিয়ে গেছে- যে ইতিহাসের তালাশ ছিলো না বহুদিন ইতিহাসের পাতায়। ষোড়শ শতকের বাংলার সুলতান আলি কুলি খানের বীরত্ব আর শৌর্যের কীর্তিগাথা যেমন মোড়ক খুলেছে সাহসী কলমে, তেমনি মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে সেইসব লোকদের, যারা একদিন বাংলার বুক থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো ইসলাম ও মুসলমানিত্বের পরিচয়। এ গ্রন্থ মুলকে বাঙলায় ইসলামের এক বিজয় নিনাদ। এ গ্রন্থ ইনসানিয়্যাতের ঝাণ্ডাকে উড্ডীন করেছে সদর্পে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর মানবপ্রীতির বন্ধনকে তুলে ধরেছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। লড়াই, রাজ্য-রাজা, ষড়যন্ত্র, প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, অশ্রু আর যুদ্ধদিনের জমাট কাহিনি সাজানো আছে ‘রাজকুমারী’র পরতে পরতে। লিখেছেনঃ মুরাদ
আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ